পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের দাবি করে আসছে। এই উন্নয়নকে তারা "রিপোর্ট কার্ড" হিসেবে তুলে ধরে। এখানে অর্থনীতি থেকে শিক্ষা পর্যন্ত কিছু প্রধান ক্ষেত্রের উন্নয়নের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:
অর্থনৈতিক উন্নয়ন:
* জিডিপি বৃদ্ধি: তৃণমূল সরকারের দাবি অনুযায়ী, তাদের সময়ে রাজ্যের জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এই তথ্যের নির্ভুলতা নিয়ে বিরোধীদের প্রশ্ন রয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সংস্থার তথ্যের সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়।
* কৃষি: পশ্চিমবঙ্গ চাল উৎপাদনে অন্যতম প্রধান রাজ্য এবং আলু উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। পাট উৎপাদনে প্রথম এবং চা উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে। তৃণমূল সরকার কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পের কথা বলে থাকে, যেমন - কৃষক বন্ধু প্রকল্প। তবে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে কৃষিতে যে স্থায়ী উন্নয়ন হয়েছিল, তার সঙ্গে তুলনা করে অনেক বিশেষজ্ঞ বর্তমান কৃষি নীতির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
* শিল্প: সরকার শিল্পায়নের চেষ্টা করলেও, কিছু সমালোচক মনে করেন যে রাজ্যে শিল্প স্থাপনে উপযুক্ত পরিবেশ নেই এবং সিন্ডিকেট, কাটমানি ও শিল্পনীতির অভাব শিল্প উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। যদিও সরকার শিল্প সম্মেলন আয়োজন করে এবং নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। সম্প্রতি, শিল্পে ইনসেন্টিভ (সুবিধা) প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তের সমালোচনা হয়েছে, যা শিল্পায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শিক্ষা:
* বিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা: তৃণমূল সরকার পৌর-স্কুলগুলির মানোন্নয়ন এবং ইংরেজি মাধ্যমে স্কুল চালুর কথা বলে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
* কন্যাশ্রী প্রকল্প: এটি একটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত প্রকল্প, যা মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় উৎসাহ যোগাচ্ছে এবং বাল্যবিবাহ রোধে ভূমিকা রাখছে।
* নিয়োগ দুর্নীতি: শিক্ষার ক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি একটি বড় বিতর্কিত বিষয়। বহু শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এবং এটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিবাদ হয়েছে। বিরোধীরা শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশার জন্য সরকারকে দায়ী করে।
স্বাস্থ্য:
* স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প: এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যের প্রায় আট কোটি মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবা পান বলে দাবি করা হয়। এটি একটি বিনামূল্যে স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প।
* মাতৃমা প্রকল্প: এই প্রকল্পের ফলে প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে বলে সরকারের দাবি।
* সামাজিক সুরক্ষা যোজনা: অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা চালু করা হয়েছে, যা বাম আমলের প্রকল্প থেকে ভিন্ন। সরকারের দাবি, এই প্রকল্পে প্রচুর মানুষ উপকৃত হয়েছেন এবং এর জন্য রাজ্য সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে।
সামাজিক উন্নয়ন ও পরিকাঠামো:
* লক্ষ্মীর ভাণ্ডার: এটি একটি জনপ্রিয় প্রকল্প, যেখানে রাজ্যের মহিলাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়।
* সবুজসাথী প্রকল্প: এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাইকেল প্রদান করা হয়, যা শিক্ষার প্রসারে সহায়ক।
* রাস্তা ও পরিকাঠামো: সরকার রাস্তাঘাট ও অন্যান্য পরিকাঠামো উন্নয়নে জোর দিয়েছে বলে দাবি করে। তবে বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে।
* সীমান্ত সুরক্ষা ও গ্রামরক্ষী বাহিনী: সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান রোধে কাঁটাতারের বেড়া ও গ্রামরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।
কিছু সমালোচনার দিক:
* তথ্য গোপান ও বিকৃতি: বিরোধীরা অভিযোগ করে যে রাজ্য সরকার প্রায়শই তথ্য গোপন করে বা বিকৃত করে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষক আত্মহত্যার তথ্য নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
* দুর্নীতি: বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ, যেমন আমফান থেকে আবাস যোজনা, কয়লা, নিয়োগ, ইত্যাদি, তৃণমূল সরকারের ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
* রাজনৈতিক হিংসা: পঞ্চায়েত নির্বাচন সহ বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক হিংসার অভিযোগ উঠেছে, যা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
উপসংহার:
তৃণমূল সরকার তাদের আমলে বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প এবং কিছু পরিকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পগুলি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তবে অর্থনৈতিক ও শিল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে শিক্ষা ও নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ সরকারের সমালোচনার মূল কারণ। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে ভিন্ন মত ও তথ্য উঠে আসে, যা যাচাই করা জরুরি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for visiting